মাধুরী দীক্ষিত
ভারতীয় অভিনেত্রী বলিউড রাণী
কথার স্রোতে শাখাওয়াত
মাধুরী দীক্ষিত (মারাঠি: माधुरी दीक्षित; জন্ম: ১৫ মে, ১৯৬৭)[১] হলেন একজন ভারতীয় চলচ্চিত্র অভিনেত্রী, প্রযোজক ও টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব।[২] অনেক সময় তাকে বলিউডের সেরা অভিনেত্রীদের একজন হিসেবে গণ্য করা হয়।[২][৩] অভিনয় জীবনে তিনি ছয়টি ফিল্মফেয়ার পুরস্কারসহ অসংখ্য পুরস্কার অর্জন করেছেন। অভিনয়ের পাশাপাশি তার সহজাত সৌন্দর্যচর্চা এবং নৃত্যকলায় সমান দক্ষতা প্রদর্শন করেন।[৪] হিন্দি চলচ্চিত্রে অনবদ্য ভূমিকার জন্য তাকে ২০০৮ সালে ভারত সরকারের চতুর্থ সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার পদ্মশ্রী পুরস্কারে ভূষিত করা হয়।[৫]
১৯৮৪ সালে অবোধ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে তার অভিষেক ঘটে এবং ১৯৮৮ সালে মারপিটধর্মী প্রণয়মূলক চলচ্চিত্র তেজাব-এর মাধ্যমে প্রথম বাণিজ্যিক সফলতা লাভ করেন ও দর্শক মহলের সর্বত্র বিপুল সাড়া ফেলেন। ১৯৮০ এবং ১৯৯০-এর পুরো দশক জুড়ে তিনি হিন্দি সিনেমার নেতৃত্বদানকারী অভিনেত্রী ও শীর্ষস্থানীয় নৃত্যশিল্পী হিসেবে একচ্ছত্র প্রাধান্য ও প্রভাব বিস্তার করেন।[৪] তিনি পরবর্তী কালে রাম লক্ষণ (১৯৮৯), ত্রিদেব (১৯৮৯), কিশেন কানাইয়া (১৯৯০), দিল (১৯৯০), সাজন (১৯৯১), বেটা (১৯৯২), খলনায়ক (১৯৯৩), হাম আপকে হ্যাঁয় কৌন..! (১৯৯৪), রাজা (১৯৯৫) ও দিল তো পাগল হ্যায় (১৯৯৭) চলচ্চিত্রে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে বলিউডের শীর্ষ অভিনেত্রী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন এবং প্রেম প্রতিজ্ঞা (১৯৮৯), পরিন্দা (১৯৮৯), প্রহার (১৯৯১), আঞ্জাম (১৯৯৪), মৃত্যুদণ্ড (১৯৯৭), পুকার (২০০০), লজ্জা (২০০১), ও দেবদাস (২০০২) চলচ্চিত্রে অভিনয় করে সমাদৃত হন। কয়েক বছর চলচ্চিত্র থেকে বাইরে থাকার পর ২০০৭ সালে তিনি সঙ্গীত-নৃত্যধর্মী আজা নাচলে চলচ্চিত্র দিয়ে অভিনয়ে ফিরে আসেন এবং পরবর্তী দশকে ব্ল্যাক কমেডিধর্মী দেঢ় ইশ্কিয়া (২০১৪), অপরাধ নাট্যধর্মী গুলাব গ্যাং (২০১৪) চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। তার প্রথম মারাঠি চলচ্চিত্র বাকেট লিস্ট (২০১৮) এবং তার সর্বোচ্চ আয়কারী চলচ্চিত্র টোটাল ধামাল (২০১৯)।
মাধুরী প্রায়ই চলচ্চিত্র অভিনেত্রী হিসেবে গণমাধ্যমসহ প্রচার মাধ্যমের সংবাদ শিরোনামে জায়গা করে নেন। তিনি মানবহিতৈষী কাজের সাথে জড়িত। ২০১৪ সাল থেকে তিনি ইউনিসেফের শুভেচ্ছাদূত হিসেবে শিশুদের অধিকার ও শিশুশ্রম বন্ধের জন্য কাজ করছেন। তিনি ভারত সরকারের "বেটি বাচাও বেটি পাড়াও" (মেয়েকে বাঁচাও মেয়েকে পড়াও) ক্যাম্পেইনের শুভেচ্ছাদূত হিসেবে নিয়োজিত। তিনি একাধিক কনসার্ট সফর ও মঞ্চ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছেন, সনি টিভি'র কাহিঁ না কাহিঁ কোই হ্যায় অনুষ্ঠান সঞ্চলনা করেন এবং নৃত্যানুষ্ঠান ঝলক দিখলা জা, সো ইউ থিংক ইউ ক্যান ড্যান্স ও ড্যান্স দিওয়ানে অনুষ্ঠানের বিচারকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৯ সালে তিনি শ্রীরাম মাধব নেনের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাদের দুই সন্তান রয়েছে।
প্রারম্ভিক জীবন
মাধুরী দীক্ষিত ১৯৬৭ সালের ১৫ই মে মহারাষ্ট্রে মারাঠী ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা শঙ্কর দীক্ষিত ও মাতা স্নেহলতা দীক্ষিত। তিনি ভারতের মুম্বাইয়ের (সাবেক বোম্বে) অধিবাসী। দীক্ষিত ডিভাই চাইল্ড হাই স্কুল এবং মুম্বাই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন ও মাইক্রোবায়োলোজিস্ট হতে চেয়েছিলেন।[৬] তিন বছর বয়স থেকে তিনি নৃত্যের প্রতি আগ্রহী ছিলেন। তিনি আট বছরের কথক নৃত্যের প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন এবং একজন প্রশিক্ষিত ও পেশাদার কথক নৃত্যশিল্পী হয়ে ওঠেন।[৭][৮]
কর্মজীবন
চলচ্চিত্রে আগমন (১৯৮৪-১৯৮৯)
মাধুরী দীক্ষিত ১৯৮৪ সালে অবোধ ছবিতে অভিনয়ের মাধ্যমে তার চলচ্চিত্রে অভিষেক হয়। কিছু শিশু ও সহ-অভিনেত্রীর ভূমিকায় অভিনয়ের পর তিনি তেজাব (১৯৮৮)[৯] ছবিতে প্রধান নায়িকার ভূমিকায় অভিনয় করেন। এ ছবিটিই তাকে খ্যাতির উচ্চতর আসনে বসায় ও প্রথমবারের মতো ফিল্মফেয়ার পুরস্কারের মনোনয়ন এনে দেয়।
তারপর তিনি বেশকিছু হিট ছবিতে অভিনয় করেন, তন্মধ্যে রয়েছে রাম-লক্ষ্মণ (১৯৮৯), পরিন্দা (১৯৮৯), ত্রিদেব (১৯৮৯), কিশেন কানহাইয়া (১৯৯০) এবং প্রহর (১৯৯১)। ঐ ছবিগুলোয় একত্রে অভিনয়ের কারণে অনিল কাপুরের সঙ্গে ভাল বন্ধুত্ব হয়।
জনপ্রিয়তা ও প্রশংসা অর্জন (১৯৯০-২০০২)
ইন্দ্র কুমারের দিল (১৯৯০) ছবিতে মাধুরী আমির খানের সাথে অভিনয় করেন। ছবিতে তিনি মধু মেহরা নামে একটি ধনী ও উগ্র মেজাজের বালিকা হিসেবে রাজা’র প্রেমে পড়েন এবং তাকে বিয়ে করে বাড়ী ত্যাগ করেন। চলচ্চিত্রটি ভারতে সে বছরের অন্যতম বক্স-অফিস হিট তকমা লাভ করে[১০] এবং অনবদ্য অভিনয়ের কারণে মাধুরী তার প্রথম ফিল্মফেয়ার শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী পুরস্কার লাভ করেন।
দিল ছবির ব্যবসায়িক সাফল্য অনুসরণ করে সাজন (১৯৯১), বেটা (১৯৯২), খলনায়ক (১৯৯৩), হাম আপকে হ্যাঁয় কৌন..! (১৯৯৪) এবং রাজা (১৯৯৫) বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করে। ‘বেটা’[১১] ছবিতে দীক্ষিতের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ছিল - একজন নারী কর্তৃক অশিক্ষিত ব্যক্তিকে বিয়ে করা ও শাশুড়ি কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হওয়া। ছবিটি তাকে সেরা অভিনেত্রীর আসনে বসিয়ে ২য়বারের মতো ফিল্মফেয়ার পুরস্কার জয় করতে সাহায্য করে।
হাম আপকে হেঁ কৌন..! ছবিটি হিন্দি চলচ্চিত্রের ইতিহাসে বৃহত্তম ব্যবসায়িক সাফল্য অর্জন করে। অর্থের অঙ্কে ভারতে ৬৫ কোটি রূপী এবং বহির্বিশ্বে ১৫ কোটি রূপী আয় করে। ছবিটির জন্য মাধুরী ৩য় বারের মতো ফিল্মফেয়ার পুরস্কার অর্জন করেন। একই বছরে তাকে আঞ্জাম ছবিতে তার চমৎকার অভিনয়শৈলী ও নৈপুণ্যের জন্য একই বিভাগে মনোনয়ন পান।
একটি অসফল বছরের পরে, যশ চোপড়ার দিল তো পাগল হ্যায় (১৯৯৭) ছবিতে পুজা চরিত্রে স্বরূপে আবির্ভূত হন। চলচ্চিত্রটি সৃষ্টিশীলতা ও বাণিজ্যিকভাবে জাতীয় পর্যায়ে ব্যাপক সাফল্য পায় এবং দীক্ষিতকে ৪র্থ বারের মতো ফিল্মফেয়ার সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার এনে দেয়।[১২] একই বছরেই প্রকাশ ঝা’র মৃত্যুদণ্ড ছবিতে অনবদ্য অভিনয় করে প্রশংসা পান। বাণিজ্যিক এবং শিল্পধর্মীয় চলচ্চিত্রের মর্যাদা পেয়ে দেশের বাইরেও খ্যাতি অর্জন করে। জেনেভা‘র সিনেমা টট একরান এবং ব্যাংকক চলচ্চিত্র উৎসবে ছবিটি শ্রেষ্ঠ পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের পুরস্কার লাভ করে। চলচ্চিত্রে অসামান্য অভিনয়ের জন্য তিনি স্ক্রিন পুরস্কার লাভ করেন।
শুধু অভিনয় দক্ষতার জন্যই দীক্ষিত পরিচিত ছিলেন না;[১৩][১৪][১৫][১৬][১৭][১৮] তাঁর নৃত্যকলাও সকলের দৃষ্টি আকর্ষন করে।[১৯] বলিউড গানে তার নৃত্যশৈলী “এক দো তিন” (তেজাব), “হামকো আজ কাল হ্যায়” (সায়লাব), “বড় দুখ দিনহা” (রাম লক্ষ্মণ), “ধক ধক” (বেটা), “চানে কে খেত মে” (আনজাম), “দিদি তেরা দেবর দিওয়ানা” (হাম আপকে হে কৌন), “চোলি কি পিছে” (খলনায়ক), “আখিয়া মিলাও” (রাজা), “মেরা পিয়া ঘর আয়া” (ইয়ারানা) “কে সেরা সেরা” (পুকার), “মার ডালা” (দেবদাস) গানগুলোয় দেখা যায় ও সকলের ভূয়সী প্রশংসা কুড়ায়।
২০০২ সালে সঞ্জয় লীলা ভন্সালীর দেবদাস ছবিতে শাহরুখ খান এবং ঐশ্বরিয়া রাইয়ের সঙ্গে অভিনয় করেছিলেন। অসামান্য অভিনয় শৈলী ও অপূর্ব দক্ষতার জন্য তিনি ফিল্মফেয়ার শ্রেষ্ঠ পার্শ্ব অভিনেত্রী পুরস্কার লাভ করেন। চলচ্চিত্রটি বিশ্বব্যাপী ব্যাপক মনোযোগ আকর্ষণ করেছিল এবং কান চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হয়েছিল এবং সেরা বিদেশি ভাষার চলচ্চিত্র বিভাগে প্রতিযোগিতার জন্য একাডেমি পুরস্কারে ভারতীয় নিবেদন হিসেবে পাঠানো হয়েছিল।
পরের বছর একটি চলচ্চিত্রে ‘মে মাধুরী দীক্ষিত বনানা চাহতি হো’ তার নামে করা হয়েছিল[২০] এবং প্রদর্শনের জন্য অনুমতি দেওয়া হয়েছিল যাতে একটি নারী (অন্তরা মালি) বলিউড শিল্পে ভাগ্য উন্নয়নের লক্ষ্যে নিজেকে মাধুরী দীক্ষিত হিসেবে পরিচিতি পেতে চেষ্টা করেছিল।[১৬][১৭]
২৫ ফেব্রুয়ারি ২০০৬ সালে দেবদাস ছবির গানের জন্য তাকে ছয় বছরের মধ্যে প্রথমবারের জন্য ফিল্মফেয়ার পুরস্কার দেয়া হয়।[২১] সরোজ খানের করিওগ্রাফীতে তিনি অনবদ্য অভিনয় করেন।
তিনি বিখ্যাত ভারতীয় চিত্রকর এম এফ হুসাইনের জন্য ‘গজ গামিনী’ (২০০০) ছবিতে নারীবাদী চরিত্রে অভিনয় করেন। ছবিতে নিজেকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য বেছে নেয়া হয়েছিল।[২২] এই চলচ্চিত্র তাকে কালীদাসের নারীচরিত্র, লিওনার্দো’র মোনালিসা, একজন উগ্রবাদী এবং সঙ্গীতবিদ ইত্যাদি বিভিন্ন নারীরূপে দেখা যায়।
ফিরে আসা (২০০৭-বর্তমান)
৭ ডিসেম্বর ২০০৬ তারিখে দীক্ষিত স্বামী-সন্তানসহ মুম্বাইয়ে ফিরে আসেন এবং আজা নাচলে (২০০৭) ছবিতে অভিনয় করেন।[২৩] চলচ্চিত্রটি নভেম্বর, ২০০৭ মুক্তি পায় এবং প্রচণ্ড সমালোচনা[২৪][২৫][২৬] সত্ত্বেও নিউ ইয়র্ক টাইমসে লেখা হয় ‘তিনি (অর্থাৎ মাধুরী) এখনও তা দেখাতে পারেন’ শিরোনামে দীক্ষিতের অভিনয়ের উচ্চ প্রশংসাসহ গভীরভাবে মূল্যায়ণ করা হয়েছিল।[২৭][২৮]
২০০৭ সালে আন্তর্জাতিক নারী দিবসে রেডিফ মাধুরী দীক্ষিতকে বলিউডের ইতিহাসে সর্বকালের সেরা অভিনেত্রী হিসেবে ঘোষণা করে।[১৩] মে ২০০৮ সালে লস এঞ্জেলসে ভারতীয় ছায়াছবি উৎসবে সম্মানিত করা হয়। মার্চ ২০১০ সালে ইকোনমিক টাইমস ঘোষণা করে যে, মাধুরী দীক্ষিত “৩৩ মহিলার একজন, যাকে নিয়ে ভারতবাসী গর্বিত”।[২৯]
ব্যক্তিগত জীবন
১৯৯৯ সালে মাধুরী কলোরাডোর ডেনেভারে কর্মরত ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্ডিওভাসকুলার সার্জন শ্রীরাম মাধব নেনে-কে বিয়ে করেন। ডাঃ নেনে মারাঠী ব্রাহ্মণ পরিবারের সন্তান।[৩০] দীক্ষিতের দুই পুত্র (আরিন, জন্মঃ ১৮ মার্চ ২০০৩, কলোরাডো এবং রায়ান, জন্মঃ ৮ মার্চ ২০০৫, কলোরাডো) রয়েছে। তার দুই বয়োজ্যেষ্ঠ বোন - রূপা ও ভারতী এবং এক বয়োজ্যেষ্ঠ ভাই অজিত রয়েছে।
ভারতে তার অগণিত ভক্ত-সমর্থকদের দাবীর প্রেক্ষিতে ২০১০ এর শেষদিকে একটি টেলিভিশন নৃত্যানুষ্ঠানে তিনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম টুইটারে যোগ দেন।[৩১]
No comments:
Post a Comment